
ঢাকার আকাশে তখনো শরতের রোদ্দুর, কিন্তু বাতাসে এক অদ্ভুত দমবন্ধ চাপা উত্তেজনা। বায়তুল মুকাররমের চারপাশে মানুষের ঢল, মুখে স্লোগান, হাতে পতাকা, তবু চোখে ভয়। কেউ জানে না, এই ভিড়ের মাঝে কতটা রক্ত অপেক্ষা করছে আজকের বিকেলের জন্য।
সকাল দশটার দিকে বাতাসে লাঠি-বৈঠার ঝনঝনানি।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমাবেশ ঠেকাতে রাস্তায় নামা কিছু উন্মত্ত হায়না। তাদের মুখে উল্লাস নয়, তাণ্ডবের আগুন। চোখের পলকে শান্ত নগরী রূপ নেয় যুদ্ধক্ষেত্রে। লাঠির আঘাতে মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা রাস্তা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, যারা রাজনীতি বুঝতেন না, শুধু শান্তি চাইতেন, সেও পড়ে থাকলেন ফুটপাতে।
সন্ধ্যার পর শহরটি হয়ে উঠেছিল এক ভয়ংকর অচেনা নগর। টেলিভিশনে ভেসে আসছিল গুলির শব্দ, আগুনের লেলিহান শিখা। মানুষ তখন বুঝেছিল এ শুধু রাজনীতি নয়, এ যেন বাংলার মানবিকতার ওপর হায়েনাদের আক্রমণ।
তারপর অনেক বছর কেটে যায়।
দেশজুড়ে ভয়, মিথ্যা মামলা, দমননীতি, মানুষ ধীরে ধীরে ভুলতে থাকে ২৮ অক্টোবরের রক্তের দাগ। কিন্তু ইতিহাস কি এত সহজে মুছে যায়? না, যায় না।

নতুন প্রজন্মের চোখে সেই দাগ একদিন ফের জ্বলে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা শুরু করে সত্যের আন্দোলন। “লাঠি নয়, কলম আমাদের অস্ত্র”-এই শ্লোগান নিয়ে তারা রাস্তায় নামে। ফেসবুকে, ক্যাম্পাসে, সাহিত্যসভায়, নাট্যমঞ্চে তাদের কণ্ঠে একটাই দাবি: “বাংলাদেশ আবার মানুষের হোক।”
২০২৩ এর ২৮ অক্টোবরে জ্বলে উঠেও নিভে যায় জনতার প্রদীপ। ফের ২০২৪-এ এসে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। চাষি, শ্রমিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, সবাই এক স্রোতে মিলে যায়।
রাজপথে নামে লাখো মানুষ, হাতে পতাকা, মুখে গান: “যে রক্ত পড়েছিল সেই দিনে, আজ তার জবাব আমরা দেবো আলো দিয়ে।”
সরকার টলে যায়, একে একে ভেঙে পড়ে ভয় আর স্বৈরাচারের দেয়াল।রক্ত, অশ্রু আর আত্মত্যাগের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে জেগে ওঠে
গণঅভ্যুত্থান ২০২৪
যে অভ্যুত্থান কেবল শাসনের পরিবর্তন নয়, এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। আজ নতুন বাংলাদেশের সকাল। রাস্তার পাশে শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে, কেউ আর রাজনীতি শুনে ভয় পায় না। মানুষ এখন জানে-গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, মানুষের মর্যাদা, জীবনের নিরাপত্তা, সত্য বলার অধিকার।
২৮ অক্টোবরের শহীদদের নাম হয়তো ইতিহাসের পাতায় ছোট্ট অক্ষরে লেখা থাকবে, কিন্তু তাঁদের রক্তে রঞ্জিত মাটিই এই নবজাগরণের ভিত্তি। সেদিনের যে অন্ধকারে হায়েনাদের তাণ্ডব ছায়া ফেলেছিল, সেই ছায়া ভেদ করেই জন্ম নিয়েছে আজকের সূর্যোদয়ে নতুন বাংলাদেশ।
ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষত একদিন আলোর জন্ম দেয়।
২০০৬-এর সেই রক্তাক্ত বিকেল থেকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান-এ পথের প্রতিটি পদক্ষেপই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার সাক্ষ্য।
বাংলার মাটিতে আজ সবার একই বার্তা…
“রক্তে রঞ্জিত অতীত ভুলে নয়, তার উপর দাঁড়িয়েই গড়বো মানবিক আগামীর বাংলা।”
মুসাদ্দেক আল আকিব
লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী



